ঐতিহ্যের বার পূজা – প্রজন্মের সাথে বহমান !

ছোট্ট তৃষাণু বাবার সাথে ক্যাবে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করছিল এই যে মোহনবাগানের বার পূজা দেখতে নিয়ে যাচ্ছো সেটা কি পূজা?
অভিজিৎ তখন ক্যাবের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দশ বছর আগের দিন গুলোর কথা ভাবছিল, কিভাবে তিলে তিলে মোহনবাগানের আল্ট্রাস মুভমেন্ট গড়ে তুলেছে – কালের নিয়মে ব্যাটন এখন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে চলে গেছে, তৃষাণু কে আস্তে আস্তে এগুলো নিয়ে ক্লাস নিতে হবে।

প্রশ্নটা শুনে অভিজিৎ ওর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো “শোন তাহলে – ষাট ও সত্তর দশকে চৈত্র মাসের আগে শেষ হত দলবদল। ক্লাবে নতুন মরুশুমের কাঠি পড়ত বছরের প্রথম দিনটিতে। নতুন অধিনায়কের নাম ঘোষণা করা হত ওইদিন। বার ছুঁয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে সংকল্প নিতেন পরের মরশুমে দলের অধিনায়ক। বছরের প্রথম দিনে ক্লাব তাঁবুতে পুজোর পর সদস্য সমর্থকদের লাইন দিয়ে লুচি বোঁদে পন্তুয়ার খাওয়ার লাইনে ঢল নামার ট্র্যাডিশন ছিল মোহনবাগানে। উল্টোদিকে ইস্টবেঙ্গলে প্রথমদিকে খাওয়া দাওয়ার জাঁকজমক তেমন ছিল না। এখন তাও কিছুটা পাল্টেছে। “

শুনে তৃষাণু জিজ্ঞেস করলো ” বাবা তাহলে কী মন্ত্র পড়া হয়? “

অভিজিৎ একটু স্মিত হেসে বললো ” সাধারণভাবে বারপুজো কলকাতা ছাড়া বিশ্বের কোনও প্রান্তে হয় বলে শোনা যায়নি। কীভাবে এই পুজো শুরু হয়েছিল সেই ইরিহাসও অজানাই থেকে গিয়েছে। এ প্রশ্নের উত্তরে পুরোহিতদের কাছে নানান ধরনের উত্তর পাওয়া গিয়েছে। কেউ বলেন, লক্ষ্মীমন্ত্র। করো মতে, বিশ্বকর্মা পুজোর মন্ত্র। আসলে হিন্দু আচার এ ক্ষেত্রে একেবারেই মুখ্য নয়। মুখ্য হল, মরশুমের শুরুতে দলের ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য ফুটবলাদের সঙ্গে সমর্থকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ক্লাব তখন যেন মিলনক্ষেত্র। একসঙ্গে পুজো দেওয়ার পর পাত পেড়ে খাওয়ার আনন্দই আলাদা।”

কিন্তু কেন করা হয় বার পুজো? বাবা বলো না প্লিজ।-” নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পয়লা বৈশাখের পর শুরু হত ময়দানের ফুটবল মরশুম। তার আগেই চালু হয়ে যেত দলবদল নিয়ে ক্লাবগুলির লড়াই। তাই বাংলা বছরের প্রথম দিনে সকলকে সাক্ষী রেখে পূজার্চনার মধ্য দিয়ে ধুমধাম করে পালিত হয় বারপুজো। কালীঘাট থেকে পুরোহিত এসে রীতি মেনে করতেন সেই বারপুজো। বারের চারপাশে থাকতেন কিছু অতন্দ্র প্রহরী। যারা পুজো শেষ না হওয়া পর্যন্ত বারটিকে পাহারা দিতেন। পাছে কেউ বার ডিঙিয়ে না যায়! আসলে বার ডিঙোলে নাকি ক্লাবের পক্ষে তা অমঙ্গল। এমনটাই মানেন ক্লাব কর্তারা।

তোর দাদুর কাছে শুনেছি আগে নাকি গোটা গ্যালারি ভরে যেত বারপুজো দেখতে। আসলে বারপুজো নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। ক্লাবের কর্তারা মনে করেন বারপুজো করলে গোটা মরশুমটাই ভালো যায়। আবার অনেকে বলেন, বারপুজো করার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হল, যাতে বিপক্ষের গোলের ক্ষেত্রে বার পোস্ট বাধা হয়ে দাঁড়ালেও নিজেদের দলের ক্ষেত্রে তা যেন কোনও সময়ই বাধা না হয়।”

বলতে বলতেই ওরা প্রায় এসে পৌঁছলো মোহনবাগান তাঁবুর গেটে, ততক্ষণে দীপিকা, সম্পদের থেকে কয়েকবার ফোন এসে গেছে অভিজিতের কাছে। বার পূজার সময়ে কিছু চমকের নাকি ব্যবস্থা করেছে মেরিনার্স বেসক্যাম্প। তৃষাণুর হাত ধরে অভিজিতের দীর্ঘকায় দেহ ক্লাবের গেটে ঢোকার সাথে সাথে আরও একটা প্রজন্মের মধ্যে মোহনবাগানের ঐতিহ্য স্থানান্তরিত হয়ে গেলো, মাঠের ভিতর থেকে তখন আওয়াজ ভেসে আসছে “চল রে দল বেঁধে চল ময়দান, মোহনবাগান করে আহ্বান”।

মেরিনার্স ব্যাসক্যাম্পের পক্ষ থেকে

শুভ নববর্ষ ১৪৩১

Loading

loader