মুম্বইয়ের দর্পচূর্ণ করে ইতিহাস গড়ল মোহনবাগান !

১৫ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত প্রায় ৯. ৩৫, সময় যেনো থমকে গেলো – কয়েক মুহূর্তের জন্য। গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো ডুরান্ডের গ্রুপ লিগের ম্যাচে মরসুমের প্রথম বড় ম্যাচের ঠিক পরের ছবি টা – মহানগরী তখন আচমকা মরসুমী বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে আর শহরের জলছবির সাথে মিশছে মোহনবাগান খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে ভেসে আসা লেখার অযোগ্য কিছু শব্দ।

মরসুমে শুরুর দিকে ডুরান্ড কাপ জেতার পরে স্বাভাবিক ভাবেই দল নিয়ে সমর্থকদের আশা, আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিলো; এএফসি কাপে বিপর্যয় এবং সুপার কাপে গ্রুপ পর্যায়ে ইস্ট বেঙ্গলের কাছে হেরে যাওয়ার পর এই প্রতিবেদক সহ অনেকেই মনে করেছিলেন এই বছরে শুধু একটা ট্রফি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কিন্তু স্প্যানিশ বয়স্ক মানুষটি অন্য রকম ভেবেছিলেন, পরিবর্তে ওঁর উপর খেলোয়াড় তথা সমর্থকদের ভরসা রাখার অনুরোধ করেছিলেন। তিনি অবশেষে করে দেখিয়ে দিলেন কেন তাঁকে ভারতীয় ফুটবলে অন্যতম সেরা বিদেশি কোচ বলা হয়। আপনার কাছে চির ঋণী হয়ে গেলো সারা বিশ্বের মোহনবাগান সমর্থকরা – আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। এশিয়া কাপের জন্যে ব্রেকে যাওয়ার আগে যেখানে মোহনবাগান লীগ শীর্ষে থাকা গোয়ার সাথে নয় পয়েন্টের ব্যাবধানে ছিল সেখানে আজ চ্যাম্পিয়ন।

গতকাল প্রথম একাদশ সাজাতে গিয়ে আন্তোনিও লোপেজ হাবাস মুম্বই এর স্বাভাবিক উইং প্লে কে আটকানোর জন্যে পাল্টা উইং প্লের উপর নির্ভর করেছিলেন। তাই ছাংতের বিপরীতে লিস্টন কোলাসো এবং মাঝ মাঠের দখল নেওয়ার জন্যে অভিষেক – জনি কাউকো – থাপার উপর নির্ভর করেছিলেন। উল্টোদিকে মুম্বই প্রথম দিকে ড্র করার মানসিকতা নিয়েই নেমেছিল, মোহনবাগান আক্রমণে উঠলেই নিজেদের বক্সের আশেপাশে দশ জন মিলে সামাল দিচ্ছিল। কিন্তু লিস্টনের জন্যে আজ কোনো প্রশংসাই যথেষ্ঠ নয়। ম্যাচের ২০ মিনিটে অনিরুধ থাপার ক্রস কে সঠিক অনুধাবন করে লিস্টন হেড করলেও পোস্টে লেগে ফিরে আসে। তারপর ২৮ মিনিটে লিস্টন তার স্বভাবচিত ভঙ্গিতে বাঁ দিক থেকে ইনসাইড কাট করে ভিতরে ঢুকে পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকে ডান পায়ের যে শট নিলেন তা জালে জড়িয়ে যেতেই যুবভারতীতে উৎসব শুরু হয়ে যায়। গোল খাওয়ার পর মুম্বই তাদের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে, এইসময় দুই প্রান্ত থেকে বিপিন ও ছাংতে বিশেষ করে ডান প্রান্ত বরাবর ছাংতে মোহনবাগান ডিফেন্স কে অনেকবার কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করে।

কিন্তু অনিরুধ থাপার উপর কাল অন্যরকম দায়িত্ব ছিল যা তিনি সসম্মানের সাথে পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বেঙ্গালুরু ম্যাচ থেকেই তাঁর খেলার মানোন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। কিছুটা ধ্বংসাত্মক ফুটবল খেলে মুম্বইয়ের মাঝমাঠের ছন্দ নষ্ট করে দিতে সফল তিনি।

এরপর ম্যাচের ৮০ মিনিটে পরিবর্ত হিসেবে নামা জেসন কামিংস ডান পায়ের শটে ম্যাচের দ্বিতীয় গোল করতেই নিশ্চিত হয়ে যায় এই মরসুমের লীগের ভাগ্য। সারা মরসুম জুড়ে অনেক সমালোচনার পাত্র হয়ে উঠলেও গোল টা ভালো চেনেন তিনি, অন্তত তাঁর পরিসংখ্যান তাই বলছে।

নির্ধারিত সময়ের একদম শেষের দিকে ৮৯ মিনিটে ছাংতে ব্যবধান কমালেও তা যথেষ্ট ছিল না মুম্বইয়ের জন্যে। এই সময়ে রেফারির বদান্যতায় হামিল বিনা কারণে লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত ৮ মিনিট মোহনবাগান দশ জনে খেলতে বাধ্য হয়। ভারতীয় ফুটবলে ইদানিং রেফারিং এর মান এতো নিচে নেমে গেছে যে প্রতিদিন কোনো না কোনো বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।

রাত প্রায় ৯. ৩৫, রেফারির শেষ বাঁশি বাজতেই সৃষ্টি হলো নতুন ইতিহাস – ভারতের প্রথম ক্লাব হিসেবে ছয় বার জাতীয় পর্যায়ের লীগ চ্যাম্পিয়ন এবং বাংলার প্রথম দল হিসেবে জাতীয় লীগ, আই লীগ ট্রফি, আইএসএল কাপ এবং আইএসএল লীগ শিল্ড জয় করলো মোহনবাগান। গ্যালারি তে তখন দ্বিতীয় বারের জন্য দোল উৎসব শুরু হয়ে গেছে। চোখের জল আর মুখের আবীর তখন মিলে মিশে স্বপ্ন পূরণের গীতিকথা লিখতে শুরু করেছে, যার সুর বেঁধে দিয়েছেন গ্যালারিতে উপস্থিত ৬১,৭৭৭ মোহন জনতা। এই বিশাল স্টেডিয়ামের শব্দব্রহ্মের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো মুম্বই সিটি এফসির ঔদ্ধত্য, জানান দিয়ে গেলো আগামী মরসুমেও রাজ করতে আসছে কলকাতার ফুটবল – যার বীজ বপন করেছে মোহন বাগান।

এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স লীগের দ্বিতীয় বিভাগে সরাসরি যোগ্যতা অর্জন করার পর এখন হাবাসের পাখির চোখ ত্রিমুকুট জয় – আইএসএল কাপ জয়। মোহনবাগান সেমিফাইনালে মুখোমুখি হবে ওড়িশা বনাম কেরালা প্লে অফ ম্যাচের বিজয়ীর সঙ্গে।

Starting XI:
Vishal(GK), Héctor, Subhasish(c), Anwar, Kauko, Abhisek, Liston, Manvir, Thapa, Dimitri, Sadiku.

Loading

loader